মিলনমেলা
অনেকদিন ধরে হাবিবুর বলে রেখেছিল, দশমীর দিন ফাঁকা রাখতে। প্রথমে কারণটা বলতেই চাইছিল না, অনেক জোরাজুরি করাতে বললো, এক জায়গায় নিয়ে যাবে। আমিও নাছোড় বান্দা। কয়েকদিন পর পরই ঘেন ঘেন করি - "বল না কোথায় নিয়ে যাবে?" শেষে পুজোর ঠিক কয়েকদিন আগে বললো টাকি যাবে, বাংলাদেশ সীমান্তে, ইছামতী নদীতে নাকি দূর্গা ঠাকুর ভাসান হয় (প্রতিমা নিরঞ্জন)। সেই উপলক্ষে উৎসবের পরিবেশ। পুনশ্চঃ আমার মা এবং বাংলাদেশের আমার এক প্রিয় বন্ধু প্রতিজ্ঞা এবং কসম খাইয়েছিল আমি যেন নৌকাভ্রমণ না করি। তাদের কথা না রাখার জন্য দুঃখিত। আসলে বন্ধুরা চাপ দেওয়াতে নৌবিহার করতে রাজি হয়ে যাই, কারণ আমি না গেলে ওদেরও যাওয়া বন্ধ হয়ে যেত আর আমরা যে এত আনন্দ করেছি, সেইটাও হত না। মরতে তো একদিন হবেই, তা বলে রোজ রোজ ভয়ে বেঁচে থাকায় কোনো মজা নেই। জীবনে একটু আনন্দ-উত্তেজনা ভালো। তা বলে আমরা বেপরোয়া হইনি। দূর্ঘটনা এড়াতে বড় নৌকা ভাড়া করেছিলাম। ছোট নৌকাতেই দূর্ঘটনা বেশী হয়, এবং আমাদের চোখের সামনে হয়েছেও।
টাকিতে হাবিবুরের এক বন্ধু থাকে নাম মজনুর রহমান। আমরা নাকি প্রথমে তার বাড়িতে যাবো, তারপরে সে আমাদের নদীর নৌকা ঘাটে নিয়ে যাবে। আগের রাতে হাবিবুর আমাকে ফোন করে বললো, সকাল ১০:৫৫ তে শিয়ালদহ থেকে শিয়ালদহ-বনগাঁও শাখার ট্রেন ছাড়বে। যেহেতু শিয়ালদহ থেকে ট্রেন আমার বাড়ির কাছের রেল স্টেশন দম দম ক্যান্টনমেন্টে আসতে ১০ মিনিট লাগবে, আমি যেন সেইমত সময় হিসাব করে ১০:৩০ -র মধ্যে তৈরি হয়ে নেই। হাবিবুরের আবার ঐ দিনই কাউকে বিমানবন্দরে ছাড়তে যাবার কথা। আমার বাড়ি বিমানবন্দর থেকে খুব কাছে। তাই ঠিক হল, হাবিবুর আমার বাড়িতে আসবে আর আমরা একসঙ্গে যাবো। প্লেন ছাড়বে সকাল ১১ টায় এবং যাত্রিরা ১০:৩০ টার মধ্যে চেক ইন করবে। যাই হোক, হাবিবুর ওনাকে রওয়ানা করিয়ে ১০:৩০ র মধ্যে আমার বাড়িতে চলে এল। আমি একটু লেট লতিফ টাইপের। ও যখন এল, আমি তখনও তৈরি হইনি, ভাত খাচ্ছিলাম। হাবিবুরও লেট লতিফ টাইপের, ওও তারাতারিতে না খেয়ে চলে এসেছে। আমাকে খেতে দেখে ওর খিদে বেড়ে গেল। আমার মাকে বললো- "কাকিমা আমিও খাব, আমাকেও ভাত দিন"। দুই জনের খেয়ে রওয়ানা দিতে দিতে পৌনে এগারোটা বেজে গেল। আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েই দুই পা দূরে স্টেশন যাবার রাস্তা। অটো রিকশার জন্য দাঁড়ালাম। দুটো ভর্তি অটো চলে যাবার পর যখন ব্যস্ত হয়ে ট্যাক্সিতে যাবার কথা ভাবছি, এমন সময় একটা ফাঁকা অটো দেখতে পেলাম। অটো সামনে আসার পরে অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম- ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন যাবেন? সে বললো যে না, পরের স্টেশন দূর্গানগর যাবে। আমরা অনন্যোপায় হয়ে যেতে রাজি হয়ে গেলাম, কিন্তু মনে ভয়ও হচ্ছিলো, ট্রেন মিস করতে পারি, বা ট্রেন গ্যালোপিং হলে ঐ স্টেশনে নাও থামতে পারে। যাই হোক, দশ মিনিটের মধ্যে দূর্গানগর স্টেশনে পৌছে গেলাম। টিকিট কাটতে গিয়ে শুনি, ট্রেন শিয়ালদহ থেকে ১০:৫৫ না ১১:৫৫ তে ছাড়বে। হাবিবুর বললো, তাহলে হয়ত মজনুর বলতে ভুল করেছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এই স্টেশনে দাঁড়িয়ে না থেকে, পরের যেকোনো ট্রেনে বারাসত চলে যাবো কারণ, বারাসত একটা সদর স্টেশন। ট্রেন গ্যালপিং হলেও বারাসতে অবশ্যই থামবে। সময় মত হাসানাবাদ লোকাল এল এবং আমরা বারাসত থেকে ঐ ট্রেনে উঠে পড়লাম। মজনুরের বাড়ি আসলে টাকি থেকে একটু দূরে নিমদাড়িয়া স্টেশনের কাছে। দুপুর ২:২০ নাগাদ আমরা নিমদাড়িয়া স্টেশনে নেমে পড়লাম। স্টেশনে আমাদের জন্য মজনুর অপেক্ষা করছিল। আমার সাথে মজনুরের পরিচয় ছিল না। পরিচয় সেরে মজনুরের মোটর বাইকে আমারা তিন জনে উঠে পড়লাম। ওর বাড়ি পৌছিয়ে দেখি ঐখানে মজনুরের আরও দুই বন্ধু মাহ্রুফ আর তপন। ওদের সাথে পরিচয় পর্ব মিটে যাবার পর, মজনুর বললো- খাবে চল। আমি বললাম- সে কী? আমরা তো খেয়েই এসেছি। ও বললো- সে তো অনেক আগে খেয়েছো। খেতেই হবে, বলে জোর করে দোতলায় নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি মুরগীর মাংস আর ভাতের ব্যবস্থা করে রেখেছে। এতক্ষণের লৌহ শকট যাত্রায় একটু একটু খিদেও পেয়েছিল, তাই কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিলাম। খেয়েই রওয়ানা হয়ে গেলাম টাকির উদ্দেশ্যে। একটা সাইকেল ভ্যান ভাড়া করা হল। ১৫ মিনিটের মধ্যে ইছামতী নদী তীরে উপস্থিত হয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখি, প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে ইছামতী সীমান্তে দুই বাংলার মিলনমেলা। দুই পারে হাজার হাজার মানুষ। ইছামতী নদীতে ছিল বাংলাদেশ-ভারতের কয়েক শ রকমের নৌকা আর ট্রলার। ও পারে সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলা। কয়েকঘন্টার মিলনমেলায় হিন্দুরাই শুধু নয়, দুই বাংলার সব ধর্মের মানুষ ভিড় করে।
তপন বেশ করিৎকর্মা ছেলে ও-ই বড় একটা মোটর নৌকাতে আমাদের যাবার ব্যবস্থা করলো।
এলাকাবাসী থেকে জানলাম, দেশ বিভাগের অনেক আগে থেকেই ইছামতী নদীর উভয় তীরে দুর্গাপূজার শেষ দিন বিজয়া দশমীতে মেলা বসে আসছে। দেশ বিভাগের পরও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি দুই বাংলার সীমারেখা। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এ মেলা কখনো বন্ধ হয়নি। সারা বছর ধরে শুধু ইছামতী নদীর পারের মানুষ নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এ দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে। বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে ইছামতীর উভয় পারে বসে নানা রকমের দোকান। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ছাড়াও এখানে আসা মানুষ কিছু কেনাকাটা করে সন্ধ্যার পরে ফিরে যায় যে যার দেশে, যে যার ঘরে।
ভারতের পাশে টাকী আর বাংলাদেশের পাশে দেবহাটা, মাঝখান দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে যাওয়া সীমান্তনদী ইছামতী বিভক্ত করেছে দুই দেশকে। ইছামতীতে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে যতদুরে চোখ যায় ভেসে বেড়াচ্ছে নৌকা আর নৌকা। নদীতে বাংলাদেশের জলসীমানায় টহল দিচ্ছে বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) স্পিডবোট আর ভারতের জলসীমানায় টহল দিচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) স্পিডবোট। নদীতীরে দাঁড়িয়ে আনন্দ উপভোগ করছে কয়েক হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য বসে অন্য রকম মেলা, সৃষ্টি হয় অন্য রকম দৃশ্য। এখানে না এলে বিশ্বাস করা কঠিন এ মিলনমেলার অনুভুতি। আমার সব থেকে ভালো লেগেছে উভয় দেশের নৌকা থেকে ছুড়ে ছুড়ে উপহার (লজেন্স, আখ, সসা, কলা, পলিথিন পাউচে জমানো শরবতের বরফ, সিগারেট, খুচরা পয়সা ইত্যাদি) বিনিময়। উভয় দেশের সাধারণ মানুষের আন্তরিকতায় আমি যারপরনাই মুগ্ধ।
স্থানীয় অনেকে বলেন, ‘বিজয়া দশমীতে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে ইছামতীর তীরে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা বসে। এটি এখন আমাদের সাংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। এখানকার অন্যরকম আনন্দ উপভোগ করতে প্রতিবছর ছুটে আসি।’
দীর্ঘদিন ধরে উভয় দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সীমান্তনদী ইছামতীতে প্রতিমা বিসর্জন দেয় (এখন অবশ্য হিন্দু জনসংখ্যার প্রধান অংশ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হওয়ায় এবং নানা কারণে বাংলাদেশে দূর্গাপূজার সঙ্খ্যা অনেক কমে গেছে)। এ উপলক্ষে যে মেলা বসে সেখানে অংশ নেয় দুই দেশের হিন্দু-মুসলমান কয়েক হাজার মানুষ। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এ প্রথা।
সন্ধ্যাবেলায় শুরু হল আকাশে আতসবাজির খেলা। ফেরার সময় নদীর পারের রাস্তা দিয়ে আমরা যখন ফিরছি, তখন ভিড়ের চাপে পিষ্ট হবার জোগাড়।
বাংলাদেশের কিছু তথ্য সংগৃহীত দৈনিক প্রথম আলো থেকে।
No comments:
Post a Comment