ব্লগারের পরিচয়

My photo
কোলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, India

Monday 13 August, 2007

ভারতের নবজাগরণ - পর্ব ১, চন্দ্রায়ণ (চন্দ্রযান-১)

ভারতের ৬০ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে, ভারতের গৌরবজনক কয়েকটি কৃতিত্ব ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করার ইচ্ছে আছে। এই পর্যায়ে ভারতের মহাকাশ গবেষণা ও আগামী চন্দ্রাভিযান সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করলাম।


মিডিয়ার কল্যাণে এই মুহূর্তে মনে হয় কারোরই আর জানতে বাকি নেই যে আর কিছুদিনের মধ্যেই চাঁদে পৌঁছে যাবে আমাদের চন্দ্রযান-১ এবং এই ব্যাপারে যে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)'র সঙ্গে ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)'র একটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে সে খবরটাও অনেকেরই জানা। তবে, এক্ষেত্রে প্রথমেই চাঁদে পৌঁছে যাবে বলাটা মনে হয় একটু ভুল হ'ল - কারণ, সে অর্থে চন্দ্রযান চাঁদে গিয়ে পৌঁছবে না। মানে, সরাসরি গিয়ে চাঁদের মাটিতে নামবে না। তার বদলে চাঁদের ১০০ কিলোমিটার ওপর দিয়ে আবর্তন করবে আর সেই সঙ্গে চালাবে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা। যেমন, রিমোট সেন্সিং পদ্ধতির সাহায্যে দূর থেকেই চাঁদের বুকে খোঁজ চলবে নানান খনিজ পদার্থের। চাঁদের মেরু অঞ্চলে বরফের খোঁজ করা হবে, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি হবে চাঁদের মানচিত্র। চাঁদের বিভিন্ন পদার্থ থেকে রঞ্জনরশ্মির বিকিরণ নিয়েও চলবে গবেষণা।

সেই কবে ১৯৬৯ সালে চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং । তার আগেও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলে গোটা চল্লিশ মহাকাশযান পাঠিয়েছিল চাঁদে। আর, তার পরে তো আরও অজস্র মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে। বস্তুত, সেই ঠান্ডা যুদ্ধের গোটা সময়টা জুড়ে, বিশ্বশক্তির দুই মেরুর মধ্যে এই নিয়ে এক ধরণের রেষারেষির সৃষ্টি হয়েছিল। এই সব অভিযানে চাঁদ থেকে নিয়ে আসা মাটি, পাথর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাও কিছু কম হয়নি। আর, সেসবের ফলে জানাও গেছে নানা নতুন তথ্য। পরবর্তী সময়ে এই উৎসাহে অবশ্য খানিকটা ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। যাই হোক, চাঁদের মাটিতে শেষবারের মতো মানুষের পা পড়েছিল ১৯৭২ সালে। সুতরাং, এ সবের আরো এত বছর পরে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আবার অতি পরিচিত সেই চাঁদে মনুষ্যবিহীন একটা মহাকাশযান পাঠানোর তাৎপর্য কী? এই জাতীয় একটা প্রশ্ন অনেকের মনেই আসতে পারে। তাই সবচেয়ে আগে দরকার এই ব্যাপারটা নিয়ে দু'একটা কথা বলা।

মানুষের প্রথমবার চাঁদে পা রাখার এত বছর পরেও আজও চাঁদ সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। সত্যি কথা বলতে কি, মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে চাঁদ আজও একটা বিরাট রহস্য। প্রথমত, সৃষ্টির প্রসঙ্গ। চাঁদের সৃষ্টি ঠিক কিভাবে হয়েছিল সেই ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। মনে করা হয়, আজ থেকে মোটামুটিভাবে ৪৫ বিলিয়ন বছর আগে, পৃথিবী যখন পুরোপুরি কঠিন অবস্থায় আসেনি, ঠিক সেই সময়ে বেশ বড় আকারের কোন মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর বাইরের দিকের বেশ কিছুটা অংশ ছিটকে মহাকাশে চলে গিয়েছিল। এটিই পরবর্তী সময়ে কঠিন হয়ে জন্ম দিয়েছিল চাঁদের। এই তথ্যের সমর্থনে যুক্তিও আছে অনেক। যেমন, চাঁদের মাটি, পাথর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে পৃথিবীর বাইরের দিকের অংশের মতো তাতেও লোহার পরিমাণ কম। কিন্তু, এসবের পরেও অনেক প্রশ্ন থেকে যায়।

আর একটা মজার ব্যাপার হ'ল, সাধারণভাবে সৌরমণ্ডলের আর সব গ্রহ আর তাদের উপগ্রহের মধ্যে আকৃতির যে অনুপাত সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়, পৃথিবী আর চাঁদের বেলায় সেটা বেশ একটু অন্য রকমের। অন্য গ্রহগুলির ক্ষেত্রে তাদের তুলনায় উপগ্রহগুলি বেশ ছোট মাপের। পৃথিবীর তুলনায় চাঁদ কিন্তু মোটেও অত ছোট নয়। কিভাবে এত বড় একটা চাঁদ আমাদের কপালে জুটলো, মতান্তর রয়েছে তা নিয়েও। তারপরে, চাঁদের দক্ষিণমেরু অঞ্চলের অ্যাইটকিন অঞ্চল নিয়েও বিজ্ঞানীমহলে কৌতূহল আর জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সাম্প্রতিককালে চাঁদে পাঠানো হয়েছে একাধিক মহাকাশযান আর সেগুলি থেকে পাওয়া নানা রকম তথ্য জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে চাঁদ নিয়ে নতুন করে গবেষণা ভীষণরকম জরুরি।

এখন প্রশ্ন হ'ল, আমাদের চন্দ্রযান-১ কিভাবে বা কতটা সেই প্রয়োজন মেটাতে পারবে বা এক কথায় কেমন হবে সেই গবেষণা ? এই প্রসঙ্গে বলা যায়, চন্দ্রযান একসঙ্গে অনেকগুলি বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান চালাবে যা এই প্রথমবারের জন্য হতে চলেছে। এই নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ করাই যায়, তবে, তা না করে বরং দু'একটির উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো একটু পরিষ্কার হতে পারে। যেমন, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে চন্দ্রপৃষ্ঠের ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করা হবে। রিমোট সেন্সিং বা দূর-সংবেদী আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সন্ধান চালানো হবে নানা রকম খনিজ পদার্থের। চাঁদের বিভিন্ন পদার্থ থেকে রঞ্জনরশ্মি নির্গত হয়। চন্দ্রযানের উন্নত যন্ত্রপাতি এইসব রঞ্জনরশ্মি বিশ্লেষণ করে চাঁদের বিভিন্ন পদার্থ সম্পর্কে নানা রকম তথ্য সংগ্রহ করবে। এইভাবে চাঁদের বুকে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি পদার্থের অস্তিত্বের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারা যাবে।

বিভিন্ন মহাকাশ অভিযান থেকে নিয়ে আসা চাঁদের মাটি, পাথর পরীক্ষা করে চাঁদে জলের অস্তিত্বের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন প্রমাণ এতদিন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ব্যাপারটা একটা অনুমানের পর্যায়েই ছিল। অবশ্য, তার একটা কারণও আছে। চাঁদের সূর্যালোকিত অংশ প্রচন্ড উত্তপ্ত, তাপমাত্রা ১৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মতো। অন্যদিকে, অন্ধকার অংশ আবার ততোধিক শীতল, তাপমাত্রা মাইনাস ১৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। স্বাভাবিকভাবেই তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা যে চাঁদের আলোকিত অংশ থেকে সমস্ত জলীয় পদার্থ বাষ্পীভূত হয়ে এই অন্ধকার অংশের শীতলতায় কঠিন হয়ে জমা হয়েছে। সম্প্রতি এই বিতর্ককে উসকে দিয়েছে একটি ঘটনা। ১৯৯৮ সালে নাসা চাঁদে পাঠিয়েছিল লুনার প্রসপেক্টর। তার নিরীক্ষণে ইঙ্গিত মিলেছে চাঁদের মেরু অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেনের যৌগ রয়েছে যা বরফ হলেও হতে পারে। সুতরাং, চাঁদে জল থাকার ব্যাপারটা এখন আর ঠিক অতটা অনুমানের পর্যায়ে নেই। চন্দ্রযান আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে চাঁদের মেরু অঞ্চলে বরফের খোঁজ করবে এবং গবেষণা করবে বাষ্পীভূত পদার্থের চলাচলের বিষয়ে। সর্বোপরি, এইসব নানা গবেষণায় যে সব তথ্য পাওয়া যাবে সেগুলির সাহায্যে সৌরমণ্ডল তথা চাঁদের উত্পত্তি ও ক্রমবিবর্তনের ব্যাপারে নতুন করে আলোকপাত করা সম্ভব হবে।

এতসব করার জন্য, বলাই বাহুল্য, আধুনিক আর উন্নতমানের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হবে এবং এই একটি ক্ষেত্রেই আক্ষরিক অর্থে ব্যাপারটা আর শুধু এদেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। অর্থাৎ, চন্দ্রযানে ভারতীয় প্রযুক্তিতে তৈরি যন্ত্রপাতির পাশাপাশি থাকছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তৈরি নানা রকম যন্ত্রপাতি। যেমন, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় আর নাসা'র অনুদানপ্রাপ্ত জেট প্রপালশন গবেষণাগারের যুগ্ম উদ্যোগে তৈরি মুন মিনেরোলজি ম্যাপার। এই যন্ত্রটি চাঁদের বুকে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের অস্তিত্বের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাবে। চাঁদের মেরু অঞ্চলে বরফের খোঁজ করবে মিনি সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার বা সংক্ষেপে মিনি সার। এটিও একটি মার্কিন যন্ত্র যা তৈরি হয়েছে নাসার সাহায্যে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকছে জার্মানিতে তৈরি একটি নিয়ার ইনফ্রারেড স্পেকট্রোমিটার যা বিভিন্ন খনিজ পদার্থের অনুসন্ধান করবে। আরো থাকছে বুলগেরিয়ায় তৈরি রেডিয়েশন ডোজ মনিটর নামে বিকিরণ মাপার যন্ত্র। এছাড়াও থাকছে সুইডেনের অ্যাটম রিফ্লেক্টিং অ্যানালাইজার। এদের পাশাপাশি থাকছে ভারতীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বিভিন্ন যন্ত্র। যেমন, চাঁদের মানচিত্র তৈরি করার জন্য টেরিন ম্যাপিং ক্যামেরা, খনিজ পদার্থ সন্ধান করার জন্য হাইপার স্পেক্টরাল ইমেজার, এক্স-রে স্পেক্ট্রমিটার ইত্যাদি।

২০০৭-০৮ সাল নাগাদ এইসব লটবহর সমেত (সম্মিলিত ওজন যদিও খুব একটি বেশি হবে না) চন্দ্রযানকে পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেইকেল-এর সাহায্যে প্রথমে ডিম্বাকার কক্ষপথে স্থাপন করা হবে, ঠিক যেভাবে কিছুদিন আগে আবহাওয়া সংক্রান্ত খবরাখবর নেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল একটি উপগ্রহকে। তারপরে ওইভাবেই দূরত্ব বাড়াতে থাকা হবে যতক্ষণ না তা চাঁদের মহাকর্ষের আওতায় গিয়ে পড়ে।

সব মিলিয়ে ২০০৭-০৮ সালে যে দারুণ একটা ব্যাপার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।


Best viewed by AdorshoLipi font. If not installed in your system, then download and paste the font file in [Fonts] folder. Go to Control Panel, Switch to Classic View (if Control Panel is in Category View, otherwise skip this step)*, right click on Fonts folder and paste.


* Applicable for M.S. Windows XP

Blog Archive