ব্লগারের পরিচয়

My photo
কোলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, India

Sunday 3 June, 2007

বিশ্বকবি ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন


১৯০৫ সাল। নানা কারণেই এই বছরটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই বছরটিতেই তত্কালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন নবচেতনায় জেগে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শ্বাসরোধ করার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করেন। তাঁর এই পরিকল্পনার কথা অবশ্য এর আগেই, মোটামুটি ১৯০৩-এর শেষ নাগাদই, জনসমক্ষে চলে এসেছিল। সে সময়ে কার্জন তত্কালীন অসমে চট্টগ্রাম ডিভিশন এবং ঢাকা ও ময়মনসিং জেলার অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দিলে সারা বাংলা জুড়েই বিক্ষোভের ঢেউ উত্তাল হয়। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন রাজনৈতিক নেতারা, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জমিদাররা। ক্ষোভে ফেটে পড়েন বাংলার সাধারণ মানুষ। কার্জনের এই প্রস্তাবের বিরোধিতায় সমগ্র বাংলা জুড়ে বহু সভা ডাকা হয়। এই প্রস্তাবকে ধিক্কার জানিয়ে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলায়ই তখন ৫০০টি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। চুপ করে বসে থাকেনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও। ভাইসরয়কে তাঁর এই পরিকল্পনা বাতিল করার আহ্বান জানাতে ১৯০৩ ও ১৯০৪ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পর পর দুটি অধিবেশনে যথাক্রমে মাদ্রাজ ও বম্বেতে প্রস্তাব গৃহীত হয়। বলা হয় তার এই প্রস্তাব বাঙালির চেতনায় আঘাত হানবে। কিন্তু সভাসমিতির মাধ্যমে এই ধরণের কিছু প্রতিবাদে কার্জনের দুরভিসন্ধির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি।
১৯০৫ সালের ২০ জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। ঐ বছরেরই ১৬ অক্টোবর (বাংলা মতে ১৩১২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আশ্বিন) থেকে তা কার্যকর করার কথা বলা হয়। শ্রেণি বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল মানুষই এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব হন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি বলেন, আইনের সাহায্যে বাংলা ভাগ হতে চলেছে ৩০ আশ্বিন, কিন্তু ঈশ্বর বাংলার মানুষকে বিভক্ত করেননি। সেই কথা মাথায় রেখে এবং তা প্রকাশ্যে তুলে ধরতে ঐ দিনটি বাঙালির ঐক্যের দিন হিসেবে উদযাপিত করা হবে। তারই নিদর্শনস্বরূপ তারা একে অপরের হাতে বেঁধে দেবেন হলুদ সুতো। মুখে বলবেন- ভায়েদের মধ্যে বিভেদ করা যাবে না। দিনটিকে রাখি বন্ধনের দিন হিসেবে পালন করার ডাক দেন বিশ্বকবি। অপরদিকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদিও অনশনের মাধ্যমে দিনটিকে শোকদিবস হিসেবে উদযাপনের প্রস্তাব দেন। দুটি প্রস্তাবই গৃহীত হয়।
এসবেরই অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ঐ দিন এক বিশাল মিছিল গঙ্গার উদ্দেশে রওনা হয়। মিছিলে অংশ নেন সমাজের বিশিষ্ট ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। ঐদিন সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে। রাস্তায় কোন যানবাহনও ছিল না। বাংলার স্বাভাবিক জীবন ছিল সেদিন অচল । গঙ্গায় ডুব দেওয়ার পর তারা একে অপরের হাতে রঙিন সুতো বেঁধে দেন। বাংলা তথা বাঙালির ঐক্য, বাঙালির সংস্কৃতি, তাদের আশা আকাঙক্ষা তুলে ধরে গান লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। সেদিন সারাদিনই কলকাতা তথা সমগ্র বাংলা জুড়ে ঐ গানটি ধ্বনিত হতে থাকে-

'বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান।।
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা-
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।।
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন-
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।।'

কলকাতার বিডন স্কোয়ারে ও বাংলার নানান জায়গায় রাখি বন্ধন উত্সবের আয়োজন করা হয়। ঐদিনই বিকেলে 'বঙ্গভবন' গড়ে তোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পার্সিবাগানে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য নিয়ে আসা হয় আনন্দমোহন বসুকে। তিনি তখন খুবই অসুস্থ। ফেডরেশন হল-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি।
প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের কন্ঠের প্রবল বন্দেমাতরম ধ্বনির মধ্যেই সভাপতির ভাষণটি পড়ে শোনান সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ঘোষণাটি পাঠ করা হয়| ইংরেজি বয়ানটি পাঠ করেন আশুতোষ চৌধুরি। বাংলা বয়ান পড়ে শোনান বিশ্বকবি। সভার পর সেই বিশাল জনমিছিল বাগবাজারে পশুপতি বসুর বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। এই ঘটনার স্মরণে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'ঘরোয়া' বইটিতে লেখেন- সভার পর জনসাধারণ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। বিশাল মিছিলটি শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অবশেষে বাগবাজারে পশুপতিবাবুর বাড়িতে পৌঁছয়।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ কবিগুরুরই লেখা একটি গান গাইতে থাকেন। তারই কিছু অংশ-

'চিরদিন টানবে পিছে, চিরদিন রাখবে নীচে-
এত বল নাই রে তোমার, সবে না সেই টান।।
* * *
আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে,
বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরীখান।।'


এর মধ্যে দিয়েই ব্রিটিশের একগুঁয়েমিকে ধিক্কার জানান বিশ্বকবি। সারা বাংলা সে সময় গুঞ্জরিত হতে থাকে এই সব গানে। কোন কোন গানে উঠে আসে রাজনৈতিক অধিকার কায়েমের ব্যর্থ বা লজ্জাজনক প্রচেষ্টা, কোথাও বা নদী ঘেরা ছায়া সুশীতল বাংলার গৌরবের কথা, শস্যশ্যামলা বাংলার ধানক্ষেতের কথা, তার তরুচ্ছায়াবৃত গ্রামগুলির কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করলেন তার সেই বিখ্যাত গান-

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে -
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কি দেখেছি মধুর হাসি।।
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো-
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে ।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মত,-
মরি হায়, হায় রে -
মা তোর বদনখানি মলিন হলে; ও মা আমি নয়ন জলে ভাসি।।

এই গানটিই এখন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ঐ বছর দুর্গাপূজার শেষ দিনে বিজয়া দশমী (২১ কার্তিক) উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ বলেন, বন্ধুগণ, এই বিজয়ার দিনে আমাদের হৃদয় ঘুরে বেড়াক সমগ্র বাংলা জুড়ে। আমাদের হৃদয় বিস্তারিত হোক উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণের উত্তাল তরঙ্গ বিধৌত সমুদ্র সৈকতে, পুবে দেশের নদীবেষ্টিত সীমানা থেকে পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চলে।... আমাদের হাত জোড় করা থাক, মাথা থাক নত। সর্বশক্তিমানের কাছে আমরা প্রার্থনা জানাই যে বাংলার মাটি ও জল, বায়ু ও ফল পবিত্র হোক।
সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার ঠিক এক সপ্তাহ আগেই ১৯০৫-এর ১৩ জুলাই কৃষ্ণকুমার মিত্র তাঁর সাপ্তাহিক 'সঞ্জীবনী'তে বিদেশি পণ্য বর্জন করে কেবলমাত্র স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের ডাক দেন। তার এই প্রস্তাব মেনে নেন সুরেন্দ্রনাথের মতো বিশিষ্ট নেতারা। রবীন্দ্রনাথও এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। তাঁর একটি গানে তিনি লেখেন- অলঙ্কার ভেবে ফাঁসির দড়ি কিনব না। 'অবস্থা ও ব্যবস্থা' শীর্ষক একটি রচনাও লেখেন তিনি। সেটি কলকাতার টাউন হল-এ আয়োজিত একটি জনসভায় ১৯০৫-এর ৭ আগস্ট পড়া হয়। দেশের কর্মক্ষমতা কাজে লাগাতে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের কথা বলেন তিনি। এই কমিটির প্রধান হবেন একজন হিন্দু ও একজন মুসলমান। সকলকেই তাদের সব কথা মেনে চলতে হবে, সব আদেশ পালন করতে হবে, তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। তাদের সম্মান জানানোর মাধ্যমেই দেশকে সম্মান জানানো হবে।
বয়কটের ধারণার প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ নন। কিন্তু সরকারি প্রশাসন বয়কট করা, সমস্ত ধরণের সরকারি কাজকর্ম থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যবস্থাপনার চিত্রটি দেশবাসীর সামনে তিনিই স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা যে শুধু চরম উত্সাহব্যঞ্জক ও উদ্দীপনামূলক গান, প্রবন্ধ ও কবিতাই পেয়েছি তা তো নয়, ভারতের ইতিহাসে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরার তাত্পর্য ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনীতে। গ্রামীণ পুনর্গঠন, সমবায় আন্দোলন, ভাষা সমস্যা ও সাহিত্যের নানান গুরুত্বপূর্ণ লেখা আমরা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। এই সময়ই দেশে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয়েও নতুন ধারণা আনেন তিনিই। আসলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ ব্যতীত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যথার্থ বিশ্লেষণ কখনোই সম্ভব নয়।



Best viewed by AdorshoLipi font. If not installed in your system, then download and paste the font file in [Fonts] folder. Go to Control Panel, Switch to Classic View (if Control Panel is in Category View, otherwise skip this step)*, right click on Fonts folder and paste.

* Applicable for M.S. Windows XP

Blog Archive