ব্লগারের পরিচয়

My photo
কোলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, India

Thursday, 18 October 2007

রেশমী ও সুস্মিতের গল্প


সুস্মিত একটু বোকা আবোধা প্রকৃতির ছেলে, কোনো কিছুই সে চট করে বুঝতে পারে না। সামান্য জিনিস বুঝতেও তার অনেক সময় লাগে। রেশমীর ব্যাপার স্যাপার, মন মেজাজ সে আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। একেতেই নারীর মন, বড়ই জটিল, দেবা না জানন্তি। তার উপর রেশমী কখন হেসে ওঠে, কাঁদে, আহ্লাদ করে, এই রোদ তো এই মেঘলা, সুস্মিত কিছুই ধরতে পারে না। সুস্মিত আগে তো কিছুই বুঝতে পারতো না, কিন্তু আস্তে আস্তে সুস্মিত একটু একটু করে বোধসম্পন্য হচ্ছে, চালাক হচ্ছে। এখন সে অনেক কিছুই ধরতে পারে রেশমীর আচরণ, ব্যবহার। সুস্মিত উপলব্ধি করতে পারে - রেশমী কথায় কথায় কারণে অকারণে হাসছে মানে রেশমীর মন ভাল নেই, বা কাঁদছে মানে রেশমী একান্তভাবে সুস্মিতকে পেতে চাইছে, বা সুস্মিতকে খুব গালমন্দ করছে, আচড়ে দিচ্ছে, খামচে দিচ্ছে, নাক কান টেনে দিচ্ছে মানে আহ্লাদ করছে।
অনেক সময় অকারণে রেশমী সুস্মিতের সাথে ইচ্ছে করে পায়ে পা লাগিয়ে এমন ঝগড়া করে, সুস্মিত বুঝে উঠতেই পারে না যে সে কী এমন করলো। আসলে কারেন্ট অফ না হলে সুন্দর জোৎস্না বোঝা যায় না, রেশমীও অকারণে ঝগড়া করে দেখে নিতে চায় সুস্মিত তাকে ঠিক কতটা ভালবাসে।

*** *** *** *** ***

সুস্মিত এক মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি হিন্দু পরিবারের ছেলে। আর রেশমী এক উচ্চবিত্ত বাঙ্গালি মুসলমান পরিবারের মেয়ে। তারা বাঙ্গালি, এইটাই তাদের মুখ্য পরিচয় হবার কথা কিন্তু তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কে হিন্দু আর কে মুসলমান এইটা বলার কী দরকার? দরকার ছিল না, কিন্তু কতিপয় সুযোগসন্ধানী ও অবাঙ্গালির দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্য সমগ্র বাঙ্গালি জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। বাঙ্গালিত্ব আজ গৌন, ধর্মই মুখ্য হয়ে দাড়িয়েছে। ভালবাসাটা যেন অভিশাপ আর সেটা যদি হয় গরীবের আর বড়লোকের, আর সেটার গায়ে যদি ছাপে হিন্দু-মুসলমানের ছাপ। প্রেম তো তাদের জন্য নয়, যেন বড়লোকের কেনা জায়গির। সুস্মিত প্রেম করেছিল রেশমীর সাথে, মেয়েটি ভীষণ সিধা সাদা নিরহঙ্কার। সুস্মিত মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল তার নিষ্পাপ মুখের দিকে। তখনও তো সে জানতো না, কি আছে তার মনের ভিতর। ছিল শান্তি আর সুখ যা ছুতে পেরেছিল সুস্মিত। চেয়েছিল ধরে রাখতে সারা জীবন ধরে। মেয়েটি চোখ নামিয়ে বলেছিল - আমার নাম রেশমী। সেই দিন থেকেই শুরু তাদের সুখের স্বপ্ন দেখা। ভুলে ছিল কিছুদিন কত কষ্ট কত জ্বালা, ভেবেছিল তারা জয়ী, গড়বে সুখের বাসা। তখনও তারা জানতো ঠিক পথ ধরেই চলছে। তারা যে সমাজের শিক্ষিতের দল, জাত ধর্মে বিশ্বাস করে না। কে বড়লোক আর কে গরীব, পরোয়া করে না। শিক্ষা তাদের সম্পদ যা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। বরং স্পর্শ করবে, আলোকিত করবে অন্ধকার। তারা হবে সমাজের দৃষ্টান্ত, তাদের দেখবে সারা সমাজ। তারা থাকবে তাদের নিজেদের ধর্ম নিয়ে, কেউ ধর্মান্তরিত হবে না কারণ তারা বিশ্বাস করতো ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে না।

এই তো অল্প কিছুদিন আগের কথা। রেশমী নামের ছোট মেয়েটা বড় হয়ে উঠতে লাগলো। আর বড় হতে হতে একটা সময় আসে যখন মনে হয় নদী শরীরের ভিতরেই বইছে, গোলাপের কুঁড়ি ফুটছে নিজের অন্দরে, চাঁদ ওর জোৎস্না ঢালছে তারই জন্য। চারিদিকে বাবা-মা, ভাই-বোন, কাকা-কাকি, ফুপু-খালা ঘিরে থাকলেও চোখ দুটো ছটফট করে খোঁজে প্রিয়তমকে, যে তার মনে তুলবে সুরের মুর্চ্ছনা, অঙ্গে অঙ্গে বাজাবে বাঁশি। রেশমীরও হল সে হাল। আর, ওমা মিলেও গেল এক পুত্তুর! না, রাজপুত্তুর নয়, বণিকপুত্তুরও নয়, ভিনধর্মী এক চিত্রকর। তুলি-কলম নয়, সে ছবি আঁকে মাউস ঘষে। সে ছবি ফুটে ওঠে মনিটরে। নড়ে-চড়ে, কথা বলে, সে এক দারুণ ব্যপার। সবাই বলে মাল্টিমিডিয়া এ্যানিমেশন।

আপু, ফুপু, সবাই রেশমীকে বলে, পাগল হলি তুই? কেউ মানবে তোর এই পাগলামি? প্রাসাদের দেওয়ালগুলো ফিস ফিস করে বলে, সাবধান রেশমী! জানো না, ওর কী হয়েছিল? তার কী হয়েছিল? রেশমী জানে, এ সব জেনে তার লাভ নেই। সে তো তার মন আর শরীরকে জেনেছে, সে আর ভয়কে জেনে করবে কী? সাত পুরুষের পরম্পরা বলে, ছিঃ, এ সব কী? বিধর্মীর ঘরে যাবে আমাদের মেয়ে? প্রেম আবার কী? পরিণয় একটা বিনিময়। রেশমীর বড় ভাইয়েরা এবং তাদের চামচেরা শাসানি দিল সুস্মিতকে, যদি আর কোন দিন রেশমীর সাথে তাকে দেখা যায়, তবে জানে মেরে দেবে।

এদিকে সুস্মিতের আত্মীয়-পরিজনেরাও ছিঃ ছিঃ করলো। অনেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মামা-মামিরা তির্যক মন্তব্য করলো। কেউ বললো- যাদের জন্য চোদ্দো পুরুষের ভিটা-মাটি ছেড়ে চলে আসতে হল, তুই কিনা তাদেরই একজনের মেয়েকে ঘরের বউ করবি? সুস্মিত বুঝতে পারে না, কেউ অন্যায় করলে তার খেসারত অন্য কাউকে কেন দিতে হবে?

বাবা বললো- তুমি যা করতে যাচ্ছো, জানো তার জন্য তোমার বোনের বিয়ে নাও হতে পারে। কে এই রকম মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে দেবে, যার দাদা কিনা একজন মুসলমানের মেয়েকে ঘরে তুলেছে? সুস্মিত বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যায়। একমাত্র মা তার সাথে আছে। মা বলে- বাবা, তুমি যাকে নিয়ে ঘর করলে সুখি হবে, আমি তাকেই মেনে নেব। কারও জন্য তুমি তোমার জীবন নষ্ট করো না। মা'র কথায় সুস্মিত মনে অনেক বল পেল।

*** *** *** *** ***

এই বছর ঈদ-উল-ফিতর ও দূর্গা পূজা কাছকাছি দিনে পড়েছে। রেশমী তার বান্ধবীদের নিয়ে গেছে ঈদের কেনাকাটা করতে এক অভিজাত শপিং মলে। রেশমীর বান্ধবীগুলো এক একটা ফাজ়িলের হদ্দ। সমানে ইয়ার্কি ফাজ়লামি করে যাচ্ছে। কিন্তু রেশমীর সেইদিকে মন নেই। তার চোখ খুঁজছে আরেকজনকে। হ্যাঁ, এই দোকানটার সামনেই তো সুস্মিত থাকবে বলেছিল। কিন্তু কই সে? সে তো কোনো দিনো দেরী করে না। প্রত্যেক দিনই তো সে রেশমীর থেকে এক ঘন্টা, আঁধ ঘন্টা আগে চলে আসে। রেশমীর মনে অনেক দূর্ভাবনা হতে থাকে।
এইদিকে, সুস্মিত আসলে অনেক আগেই চলে এসেছিল, কিন্তু রেশমীর বান্ধবীদের পুরো ব্যাটেলিয়ান দেখে, ঘাবড়ে গিয়ে দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। রেশমীর চঞ্চলতা দেখে একটু মজাও পেয়েছে। রেশমীর কাছে, সুস্মিতের অনুযোগ ছিল যে সে রোজই দেরী করে আসে আর তাকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আজকে সুযোগ পেয়ে সুস্মিত সেই অভিমান উসুল করে নিচ্ছে। কিন্তু সুস্মিতের আর ভাল লাগছে না, রেশমীর অসহায়তা দেখে তার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। নিষ্ঠুরের মত সে আর লুকিয়ে থাকতে পারছে না।
সুস্মিতকে পেয়ে রেশমীর বান্ধবীরা রব তুললো, তাদের রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে হবে। এত জনকে খাওয়াতে হবে দেখে সুস্মিত প্রমাদ গুনলো। সামনে পুজো, সবাইকেই কিছু না কিছু দিতে হবে, পুজোর বোনাস এখনও পায়নি। পাবে কিনা ঠিকও নেই, কোম্পানির যা অবস্থা, বেতনই ঠিক মত হচ্ছে না আবার বোনাস! সুস্মিতের মুখ দেখেই রেশমী ব্যাপারটা বুঝে গেল। সে খেঁকিয়ে বান্ধবীদের ফাজ়লামির সুরে বললো - তোদের লজ্জা করে না? কোথায় আমাদের একটু নির্জনতার মধ্যে প্রেম করার ব্যবস্থা করে দিবি, তা না, কাবাব মেঁ হাড্ডি হতে চাইছিস!
সুস্মিত, রেশমীকে নিয়ে শপিং মলের দোতলায় একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। রেশমী বললো - প্লিজ়, আজকে সবার সামনে বসবো না, চলো আজ একটা প্রাইভেট কেবিনে বসি।


রেস্টুরেন্টটা বেশ ভাল। হাল্কাভাবে একটা হিন্দী গান ভেসে আসছে -
"প্যাহলী বারিশ ম্যায় অর তু,
দূর সে ভিনি খুশবু আয়ে
আব ক্যা হো গা আনজাম
খুদা জানে ..."

সুস্মিত আর রেশমী দুজনের মন-মেজাজটা আজকে খুব রোম্যান্টিক হয়ে আছে।

রেশমী: এই জানো, তোমার ফোন কল পেয়ে আজকে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে। আজকে অনেক দিন পর তোমার সাথে দেখা হবে ভেবে সকাল থেকে একটা অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছিল। কাল তোমার সাথে কত ঝগড়া করেছি ফোনে, তবুও মনে মনে আশা করছিলাম, তোমার কল আসুক, কল আসুক। তুমি কল করার পরে খালি মনে হয়েছে, তোমাকে কাল কত আঘাত দিয়েছি, কত আবল তাবল কথা বলেছি।

সুস্মিত: বাদ দাও। আমি জানি, কাল তুমি কোনো কথাই মন থেকে বলনি। তুমি বলতে পারো না, কারণ ...

রেশমী: কী কারণ?

সুস্মিত: কারণ, তুমি যে আমাকে কত ভালবাসো, আমি তা জানি।

রেশমী: না জানো না। কতটা ভালবাসি?

সুস্মিত: জানি না, যাও।

রেশমী: রাগ করছো কেন সোনা? তোমাকে রাগাচ্ছিলাম। তোমাকে ভালবাসতে পারলে যে কেউ ধন্য হবে।

সুস্মিত: আহা! তুমি এই কথা বলাতেই আমি খুব খুশী হয়েছি। আমার আর কিছু চাই না। আমি ধন্য।

রেশমী: খুশী হবার মত এমন কিছু বলিনি। তুমি এমন ভাবে বল যেন তুমি নগন্য একটা মানুষ। অথচ তোমার জন্য মানুষ তুচ্ছ ভাবতে পারে নিজেকে, তুমি কারও চোখে অসাধারণ হতে পারো, আর তোমাকে নিয়ে কারও অনেক বড় পাগলামি থাকতে পারে। তুমি এইটা অনুভব করতে পারো না কেন?

সুস্মিত: তুমি প্রেম-ভালোবাসা বলতে কী বোঝ?

রেশমী: (লাজুক হাসি হেসে) আমি ভালবাসা বলতে বুঝি- যেমন ধর, তোমার গা ঘেসে কেউ ঘুমাচ্ছে, তুমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছো, ইচ্ছে করলেই একটু ছুঁইয়ে দেখতে পারছো ... অবাক চোখে তোমার খুব নিজের একটা মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করছো। আর আমার নিজের একান্তভাবে যা মনে হয়, মানে আমার নিজের যা চাওয়া তা হল- কারও বুকের কাছে লুকিয়ে শান্তির একটা ঘুম, আর মাঝে মাঝে পাস ফিরতে গিয়ে তার গায়ে পা তুলে দেওয়া ... হা হা হা হা !
ব্যস, আর জানি না। আমার কল্পনার দৌড় এই অবধি। এর পরে কি হবে জানি না। এবার তুমি বল, ভালবাসা বলতে কি বোঝ?

সুস্মিত: আমি ভালোবাসা বলতে বুঝি, দুজনে দুজনায় হারিয়ে যাওয়া। দুজনের আলাদা অস্তিত্ব থাকবেনা। এক হয়ে যাবো।

রেশমী: (ফাজিল হাসি হেসে) এক হয়ে যাবে মানে? কি করে? ধুর! কী যে বল? তাহলে ডাকাতের মত আচরণ কে করবে? হা হা হা হা !

সুস্মিত: (লাজুক অথচ ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে) ডাকাতের মত আচরণ? হা হা !! সে তো আরও পরে। যখন তাদের মধ্যে একটা সুতোরও ব্যবধান থাকবে না, কাপড় তো দূরের কথা।

রেশমী: (নকল রাগ দেখিয়ে) তোমরা ছেলেরা খালি একটা জিনিসই জানো!

সুস্মিত: তাই? হা হা হা হা !

রেশমী: কিন্তু তোমার রোমান্টিকতায় আমি মুগ্ধ।

চোখে চোখ, হাতে হাত রেখে দুজনেই অনেক ক্ষণ মুখোমুখি চুপ চাপ বসে রইল। সম্বিত ফিরলো রেস্টুরেন্ট বয়ের আগমনে।

বয়: ইয়োর অর্ডার প্লিজ়।

... ... ...

আর তিন মাস পর সুস্মিত ও রেশমীর শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হবে। আপনারা সবাই আশীর্বাদ করবেন যেন নবদম্পতি চিরসুখি হয়।।

Blog Archive