ব্লগারের পরিচয়

My photo
কোলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, India

Wednesday 19 March, 2008

একটি অতৃপ্ত আত্মার জবানবন্দি

মাঝ রাতে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সারা শরীর ছটফট করছে, হৃদ্‌স্পন্দন প্রচণ্ড তীব্র। না পারছি শুতে, না পারছি বসতে। ঘাড় এবং মাথায় চাপ ধরা ব্যথা। চোয়ালটা যেন কেমন শক্ত হয়ে আসছে। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই চরম অস্বস্তিতে আর থাকতে পারছিনা। মনটাকে প্রচণ্ড একটা মৃত্যুভয় গ্রাস করে নিচ্ছে। আর বিছানায় থাকতে পারলাম না। অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে কোনোরকমে মশারি সরিয়ে খাট থেকে নেমে এলাম। টালমাটাল পায়ে অন্ধকারের মধ্যে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার ঘর এবং বসার ঘর পেরিয়ে যেতে চাইছিলাম মা বাবার ঘরে। মা-কে ডেকে বলতে চাইছিলাম - "মা, আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে ..."। কিন্তু নাহ্‌, যেতে পারলাম না। দরজার কাছে এসে পড়ে গেলাম। অর্ধেক শরীর আমার ঘরে, বাকী অর্ধেক খাবার ঘরে। অনেকক্ষণ কোনো হুশ নেই।
এইভাবে কতক্ষণ যে পড়ে আছি, জানিনা। হঠাৎ খুব শীতের অনুভুতি হতে লাগল। তারপর একসময় আর কোনো অনুভুতি নেই। তারপর উঠে দাড়ালাম। মেঝেতে কালচে মত চটচটে কী যেন একটা তরল পড়ে ছড়িয়ে আছে? চটচটে তরলটা এড়িয়ে কিছুটা সরে আসলাম। ভাল করে দেখবার চেষ্টা করলাম। দরজার কাছে কে যেন পড়ে রয়েছে? কেমন চেনা চেনা লাগছে! হ্যাঁ, একে তো আমি চিনি। কতবার আয়নায় দেখেছি এর প্রতিচ্ছবি। এ তো আমি। কী আশ্চর্য! নিজেকে নিজে দেখছি কি করে? সামনে কোন আয়না তো নেই। আমি এমনভাবে মেঝেতে শুয়ে রয়েছি কেন? নাক দিয়ে মুখ দিয়ে কালচে লাল মত তরলটা গড়িয়ে মেঝে ভেসে যাচ্ছে।
এবার সম্বিত ফিরলো। বুঝতে পারলাম- আমি আর নেই। মানে, আমার দেহের মৃত্যু হয়েছে। এখন আমি হলাম শুধুই এক অতৃপ্ত আত্মা।
সব কিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। নিজের মৃত্যুতে, চরম অতৃপ্তিতে নিজেরই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বাবা মা'র ঘরে যেয়ে দেখি ওরা ঘুমাচ্ছে। এই তো সবে তিন ঘন্টা আগে ওরা শুতে গেল। ওদের ডাকতে গিয়েও আর ডাকতে পারলাম না। থাক না আরেকটু ঘুমিয়ে, খুব মায়া হল। প্রথম সন্তানের মৃত্যু শোক ওরা কিভাবে সইবে? শেষবারের মত মা'র পাশে শুতে ইচ্ছে করল। মা'কে জড়িয়ে ধরে ডাকতে ইচ্ছে করল - "মাআআআ"।
এত কাছে মা'কে কোনো দিনও পাইনি। বেঁচে থাকতে, ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, মা অফিসে যাবার জন্য তৈরি। ইস্কুল থেকে এসে বিকালে, ঢেকে রেখে দেওয়া খাবার নিজে হাতে বেড়ে নিয়ে খেয়ে, মা'র ছেড়ে যাওয়া শাড়ীটাকে পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঐ শাড়ীটাতে একটা অদ্ভুত সুন্দর মা মা গন্ধ থাকতো।
পাশ ফিরে বাবার দিকে তাকালাম। দুঃখে গলা বন্ধ হয়ে গেল। বাবাকে জড়িয়ে কেঁদে বললাম - "বাবা, আমি তোমার কোনো স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। আমি সত্যই Good for nothing."
একী! কেউ কিছু টের পাচ্ছে না কেন? ওওও! টের পাবে কী করে? আমি তো শুধুই এক অতৃপ্ত আত্মা।
ভোর হয়ে গেছে, পাখীরা ডাকতে শুরু করেছে, চারিদিক আস্তে আস্তে আলোকিত হয়ে উঠছে। এর পরে সব ঘটনা দ্রুত ঘটতে লাগলো। মা'র ঘুম ভাঙ্গলো। অভ্যেস বসতঃ, চা করতে যাবার আগে মা একবার আমার ঘর থেকে ঘুরে আমাকে দেখে যায়। আজকেও দেখতে এসে ঘুম চোখে দরজার কাছে হোঁচট খেল। নিচে তাকিয়ে দেখে আমি পড়ে আছি। চিৎকার করে উঠে মা, বোন আর বাবাকে ডাকলো। ওরা তিনজনে কোনোরকমে আমার শরীরটাকে ধরে খাটে শুয়ে ডাকতার ডাকলো।
ডাকতার এসে পরীক্ষা করে আমার ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিল। একে একে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবেরা এল। পাড়া-প্রতিবেশীরা এল। হা হা!! এইবার বেশ মজাই লাগছে।
সারা ঘরে ফুল, মালা, ধুপ ও সুগন্ধির গন্ধে ম ম করছে। আর কিছুক্ষণ পরেই আমার শরীরটাকে নিয়ে যাওয়া হবে শ্মশানে। শেষবারের মত নিজেকে দেখছি। কয়েকটা মাছি নাকের কাছে, মুখের কাছে, কানের কাছে বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে।
এই তো জীবন! আর কিছুক্ষণ পরে সাধের এই দেহটা দুমুঠো সাদা ছাই হয়ে যাবে।

Blog Archive